বাচ্চা ভূতটা হাড্ডিসার। মাথার খাপরি বের হয়ে এসেছে। চোখ দুটো গর্তে লুকানো। টর্চ লাইটের মতো তা ঠিকরে বের হচ্ছে। যেনো জয়নুলের দুর্ভিক্ষের সচল কোনো চিত্র। ‘আমরা এইহান থাইক্যা যাইগা মা’ বাচ্চা ভূত মা ভূতকে বলে।

‘যাবি’ বলে মা ভূতটা বিষন্ন দৃষ্টি মেলে।

মা ভূতটাও হাড়জিরজিরে। পাঁজরের সবগুলো হাড় গোনা যায়। পাটকাঠির মতো তা বের হয়ে আছে।

‘হ, যাইগ্যা। এইহানে আর থাকা যাইবো না। সব গাছ কাইট্যা ফালাইত্যাছে। সারারাত বিজলি বাতি জ্বলে। হ্যার জন্য রাইতে ঘর থাইক্যা বাইর হয়া যায় না। খাওয়া নাই।’

‘তর তো এইহানকার জন্য কোনো মায়া পয়দা হয় নাই। হেইদিন হইলি মাত্র। আমি কত বছর ধইর‌্যা এইহানে আছি। এই মায়া রাইখ্যা কই যামু, ক।’

‘নিশিবয়রা বিলে যাবি মা।’

‘হেইদিন দেখলি না, গোলাম জাইল্যা খালি হাতে ফিরলো। কোনো মাছ নাই বিলে। তাঁতের সুতার রঙের পানি গিয়া সব মাছ মাইর‌্যা ফালাইছে। বিলের মইধ্যে যে হিজল গাছটা আছিল, সেটাও মইরা গ্যাছে। ওইহানে গিয়া ক্যামনে থাকবি।’

‘মা, এইহানে আর ভালো লাগে না।’

‘তর দুঃখ বুঝি রে বাপ। তুই যে খেলবি, সেই গাছ নাই। বাঁশঝাড়টাও পাতলা হইয়া গ্যাছে। সব গাছ কাইট্যা ফেলছে মোল্লার পুত। আকন্দ বাড়ির মেছো ভূতরাও চইলা গ্যাছে। বড় একলা হইয়া গ্যাছোস তুই।’

‘মা, তুই এইহানে কবে আইছিলি।’

‘বোকা ছেলের কথা শোনো। এইহানে কী আমি আইছি। আমার তো জন্মই এইহানে। তর দাদার দাদা তারও দাদা প্রথম এইহানে আইছিলো। বাপের মুখে হুনছি, সে সময় কত গাছ আছিলো। বিরাট বিরাট সব গাছ। আম গাছ, তেঁতুল গাছ, শিমুল গাছ। একটা বিশাল বটগাছও আছিলো। যখন এইহানে আইছিলো তহন তো শাহজাদপুরে প্রজা বিদ্রোহ শুরু হইছে। কতকাল আগের কথা। সেই ব্রিটিশ আমল। জমিদাররা জমির খাজনা বাড়াইয়া দিছে। কৃষকরা কয়, তারা খাজনা বেশি দিবার পারবো না। এটা তাদের ওপর জুলুম হইছে। জমিদাররা করে কী, তাদের লাইঠাল বাহিনী দিয়া কৃষকদের মারধর করে। কৃষকরাও লাঠি হলঙ্গা নিয়া জমিদারদের মারবার যায়। তখন কৃষকগো দলের নেতা ক্ষুদি মোল্লা তাঁর দলবল নিয়া একবার এইহানে আছিলো। তহন এই জায়গাটা এমুন আছিলো না। গাছপালা দিয়া বিশাল আড়া হইয়া আছিলো। হ্যার জন্য দেখতে পায়নাই লাইঠালরা। কী সাহস আছিলো লোকটার।’

‘মা, তহন আমগো কি এতো কষ্ট আছিলো?’

‘তহন আমগো কত শান্তি আছিলো রে পুত!’

মট মট করে তেঁতুল গাছটা ভেঙ্গে পড়ে। কামলাদের শোরগোল শোনা যায়। মা আর বাচ্চা ভূতের শান্তি ভঙ্গ হয়। একটা কাকের বাসা ভেঙ্গে পড়লে মোক্তার মোল্লার নাতি আওয়াল কাকের বাসা থেকে সাবান, চুড়ি, এক টুকরো কাপড়ের সাথে একটি ডিম আবিস্কার করে। ডিমটি নিয়ে মোল্লার নাতি সবাইকে দেখাতে গেলে কাকটি তার পেছন পেছন ছোটে। আওয়াল এতে আরো বেশি আমোদ পায়।

এই তেঁতুল গাছটা কতদিনের পুরানো তা মা ভূতটাও মনে করতে পারে না। মানুষরা কত যে গল্প বলে এই গাছটি নিয়ে। এর কোনোটা সত্য, কোনোটা মিথ্যা। আবার কোনোটা সত্য-মিথ্যের মিশেল। তেঁতুল গাছটা নিয়া মানুষগো অভিযোগেরও অন্ত নাই। একবার বারেক মোল্লার বড় মাইয়া আলেয়া পোয়াতি হইয়া বাড়িতে আইলো। তহন জ্যৈষ্ঠ মাস। কয়েকদিন পর আলেয়া এক কটকটে দুপুরে একটা মরা মাইয়া বিয়াইলো। আলেয়ার জামাই ওয়াদুদ মিয়া সব দোষ দিলো তেঁতুল গাছের ভূতের। শাহপুর মাদ্রাসার বড় হুজুর এসে মন্ত্র পড়া দিলো। মন্ত্র দিলে কী হবে, ভূতেরা তো আর কিছু করে নাই। বড় হুজুর এসে খালি খালি কয়েকদিন ভূতদের কষ্ট দিলো।

হেইবার-ই কে যেন কইছিলো তেঁতুল গাছটি কেটে ফেলতে। গাছ কাটলে ভূতেরা যদি ক্ষেইপ্যা যায়, সেই ভয়ে কেউ কাটতে সাহস পায় নাই। কেউ কেউ মনে করতো, গাছে যে প্রথম কোপটি দিবে, তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মইরা যাবে। হ্যার জন্য কেউ এতোদিন কাটতে রাজি হয় নাই। কিন্তু বাতেন মোল্লার ছেলে সোহেল শহরে শিক্ষিত ছেলে। ভূত-প্রেতে তার বিশ্বাস নাই। সেই আজকে কাইট্যা ফেললো তেঁতুল গাছটি।

সোহেল হয়তো তেঁতুল গাছটি কাটতো না। ভূত-প্রেতে ভয় না পেলেও ছোটবেলা থেকে তেঁতুল গাছের ভূত সম্পর্কে এতো কিছু শুনে এসেছে যে তাতে তেঁতুল গাছটি কাটতে গেলে তাকে দুইবার ভাবতে হতো। কিন্তু গত সপ্তাহের একটি ঘটনা তাকে কাটতে অনেকটা বাধ্যই করলো। গত সপ্তাহে বউরে নিয়ে গেছিলো আকতার ফার্নিচার্সে। উদ্দেশ্য ছিল একটা ড্রেসিং টেবিল কিনবেন। কিন্তু বউ একটা খাট পছন্দ করে ফেললো। দাম সাকূল্যে ৫৫ হাজার টাকা। বউয়ের গোঁ, এই খাট কিনা দিতে হইবো। একটু কষ্ট হলেও খাট কেনার সামর্থ্য সোহেলের আছে। কিন্তু সোহেল বউয়ের সব কথা শোনার মতো বোকা নয়। মনে মনে বুদ্ধি আঁটলো, গ্রামের বাড়ির তেঁতুল গাছটি কেটে এই ডিজাইনের একটা খাট বউকে বানিয়ে দেবে।

সোহেল শহর থেকে এসে যেদিন বলল, তেঁতুল গাছটি কেটে খাট বানাবে, ওয়্যারর্ডোব বানাবে, সে দিন তার দাদী জাহানারা বেগম ভয়ে আঁতকে উঠলেন। অনেক করে বোঝালেন তার বেয়াড়া নাতিকে। বললেন, তেঁতুল গাছের ভূতটা ভালো না। সংসারে অনিষ্ট করবে। সোহেল শুনে নাই দাদীর কথা। মনে মনে ভেবেছে, খাট না বানালে সংসারে এমনিতেই অশান্তি আসবে।

গাছ কাটা শেষ হলে করাতকলে তা চেরাইও করা হয়। এইবার খাট বানাতে হবে। সোহেল আকতার ফার্নিচার্সের ডিজাইন পকেটে নিয়ে ঘোরে। আর খুঁজতে থাকে কে বানিয়ে দিতে পারবে এরকম খাট। এই খুঁজতে গিয়েই সোহেলের পরিচয় হয় লিটন সূত্রধরের সাথে। লিটন সূত্রধর সোহাগপুর হাটের পূর্ণিমা ফার্নিচার্সের মালিক। ‘আসমান থাইক্যা ডিজাইন আইনা দিলেও এই বান্দা আপনার মাল রাইত পোহাইলেই ডেলিভারি দিবো। তয়, আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়- তেঁতুল গাছের কাঠ বহুত ভালো কাঠ। মাগার আপনের পোলাও ঘুণে ধরা ছাড়া পার কইরা দিবো।’

লিটন ছুতারের কথা শুনে সোহেলের আফসানার কথা মনে পড়ে। একসাথে খাট, ওয়্যারডোর্ব দেখলে আফসানা সত্যিই খুব খুশি হবে। মনের কোণে আফসানার হাসিমুখের ছবি ভেসে উঠতে দেখে সোহেলেরও খুব ভালো লাগে। তার মনে হয় তেঁতুল গাছের কাঠের মতো তাদের সংসার যেন টেকসই হচ্ছে!